কিছু কথা
কক্সবাজার জেলার সর্বস্তরের বৌদ্ধদের নিয়ে সমন্বিতভাবে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর এই সংগঠনটি গঠন করেছিলাম। এই পরিষদ গঠন করার সময় সমগ্র কক্সবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলা থেকে প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করে মতবিনিময় সভা করেছিলাম। উক্ত সভায় আমাকে সভাপতি নির্বাচন করে একটি কার্যকরি পরিষদ গঠন করা হয়। একইসাথে সভায় পরিষদের নামকরণ নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় আমি একাধিক নাম উত্থাপন করলে উপস্থিত সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ “কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ” নামটি সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচন ও অনুমোদন করেন।পরবর্তীতে কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধনেতৃবৃন্দের সাথে নবগঠিত ‘কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ’ পাহাড়তলী বইল্যাপাড়াস্থ উ কুশল্যা বৌদ্ধ বিহারে মতবিনিময় কালে উক্ত সভা থেকে “জেলা” শব্দটি পরিষদের নামের সাথে যুক্ত করার জন্য প্রস্তাব করা হয়। যদিও বা কক্সবাজার মানে সমগ্র কক্সবাজার জেলাকেই আমরা বুঝাতে চেয়েছিলাম। তবুও উক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে “কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ” নামটি চুড়ান্ত করা হয়। এরপর থেকে আমরা আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সাল নাগাদ টানা এক বছর ধরে কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধপল্লী তথা এলাকাগুলোর আনাচে-কানাচে বিচরণ করেছি। এভাবে টানা এক বছর এ কাজের পেছনে পড়ে থেকে রীতিমত সম্মেলন করে জানান দিয়ে প্রত্যেক উপজেলায় শাখা কমিঠি দিয়েছি।
“কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ” নিয়ে অনেকের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ভিন্নতা থাকতেই পারে।আমাদের কার্যাবলি এবং অবস্থান সম্পর্কে যাদের কাছে সুস্পষ্ট ধারণা কিংবা পর্যবেক্ষণ নেই তারা এ পরিষদের কর্মকান্ড নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারেন। আমি সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু বিভাজনে বিশ্বাসী নই। কারণ বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি এবং জন্মভূমি। আমার নাগরিক পরিচয় হলো আমি বাংলাদেশী। আমার মাতৃভাষা বাংলা তাই আমি বাঙ্গালি। এটা আমার ভাষাগত পরিচয়্ একথাও মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এবং ভাষা বৈচিত্রের দেশ। এদেশের নাগরিক অনেকের মাতৃভাষা বাংলা নয়। তারা অবাঙ্গালি। কিন্তু বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি, পাহাড়ী, আদিবাসী আমরা সবাই বাংলাদেশী। ধর্মের পরিচয়ে আমরা কেউ বৌদ্ধ, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম, কেউ খ্রিস্টান ইত্যাদি। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমার প্রথম পরিচয়টা নাগরিক পরিচয় হওয়া উচিত। ধর্মীয় অনুসারীদের মধ্যে তুলনা করা হলে এদেশে বৌদ্ধরা সংখ্যার দিক থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু। কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমরা মোটেও সংখ্যালঘু নই। রাষ্ট্রের কোন মানুষ নিজের মধ্যে সংখ্যাগুরু মনোভাব (সুপারিউটি) পোষণ করলে যেমন দেমাক আর জাতিবিদ্বেষকে লালন করা হয় তেমনি সংখ্যালঘু মনোভাব (ইনফেরিউরিটি) পোষণ করলে হীনমন্যতা আর জাতিবিদ্বেষকে লালন করা হয়। তাই আমি নাগরিক হিসেবে সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু নামে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক তত্ত্ব বিশ্বাস করতে চাইনা। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাম্প্রদায়িকতা ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ভিত করে যে মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন এর বাস্তবায়ন করতে হলে সাম্প্রদায়িকতাকে রুঁখতে হবে। সেই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। তবে হিংসা দিয়ে নয়; মৈত্রী, মেধা, প্র্রজ্ঞা, একতার শক্তি দিয়েই আমাদেরকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে জয় করতে হবে। কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ সেই মৈত্রী, মেধা, প্র্রজ্ঞা, একতাময় শক্তির একটা টেকসই প্লাটফর্ম তৈরি করার স্বপ্ন দেখে যেখানে থাকবে না কোন বৈষম্য, এলাকাবাদ, অঞ্চলবাদ, গুরুবাদ এবং সাম্প্রদায়িক আস্ফালন। শুরুটা কক্সবাজার থেকে করলেও নিকট ভবিষ্যতে এই পরিষদকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা এবং সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা আছে।
মৈত্রীসহ
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু
প্রতিষ্ঠাতা, কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ।